৮ই মার্চ, বিশ্ব নারী দিবস নিয়ে অনেকের মনে অনেকরকম ভাবনা। কেন বিশ্ব নারী দিবসে এতো ঘটা করে নারীদের বঞ্চনার কথা জানানোর জন্য এতো এতো আয়োজন করা হয়? কেন এই দিনে “সফল” নারীদের কথা নানা গনমাধ্যমে ঢাকডোল পিটিয়ে জানানো হয়?
অনেকেরই এক সরল প্রশ্ন,” নারীদের জন্য নারীদিবস এমন ঘটা করে উদযাপন করা হলে বিশ্ব পুরুষ দিবসটি কেন এমনভাবে ঘটা করে উদযাপন হয় না?”।
আসলে প্রশ্নটা যদি এমন হত যে কেন এতো বছর ধরে নারীদের এই দিনটা পালন করা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী নারীদের বঞ্চনা আশানুরূপ হ্রাস পাচ্ছে না কেন তবে হয়ত নারীদের কাছে প্রশ্নটা ভালো লাগত। একজন নারী ; সমাজে মেয়ে, বউ, বোন, বান্ধবী যে রূপেই থাকুক না কেন বাস্তবিক অর্থে স্বাধীনভাবে জন্ম নেয়া প্রানী হলেও স্বাধীন প্রানী রুপে মারা যাবার সৌভাগ্য সবসময় পায় না। আরো পরিষ্কার করে বললে, মানুষ হবার পাশাপাশি তাকে মেয়েমানুষ করে তোলবার জন্যেই সকল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বাহকরা ব্যস্ত থাকে। নারী-পুরুষ দৈহিক এবং মানসিক দিক থেকে ভিন্ন। তাই এদের একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে সমঅধিকার চাইবার হেতু নেই কোনো! তবে এ লিংগীয় ভিন্নতার মানে এই না যে সমবয়সী ছেলে-মেয়ে উভয়কে পুষ্টিকর খাবার দেয়ার রীতি রাখা যাবে না! আরো খোলাসা করে বলা যায়, যদি কোনো বাড়িতে শিশুদের দুধ খাবার রীতি থাকে তবে কেবল ছেলেশিশুই দুধ খাবে না। কন্যাশিশুটিও পুষ্টিকর খাবার পাবে তার ভাইয়ের মতো।
সমধিকার মানে এই না যে ছেলেরা মৃত মায়ের লাশের খাটিয়ে ঘাড়ে নিচ্ছে বলে মেয়েদের ও তাই করা চাই! কিংবা মেয়েদের প্রতিমাসে ঋতুস্রাবের সময় বাড়তি সচেতনভাবে চলার প্রয়োজন আছে বলে ছেলেদেরও প্রতিমাসে ৫-৭দিন ভারী কাজ থেকে মেয়েদের মতো বিরত থাকতে হবে!
সমঅধিকার বলতে আমরা নারীরা চাই, সেই সকল বাড়তি বঞ্চনা থেকে মুক্তি, যা হয়ত সমাজ আমাদের একজন পুরুষ হলে সম্মুখিন করাত না। দু’টি উদাহরণ দিয়ে বলি,
ধরুন –
১।অনেক সময়ই বাসের সংরক্ষিত ৯টি সিট শেষ হয়ে গেলে নারীদের পাবলিক পরিবহনে প্রবেশ না পাবার মত বঞ্চনার শিকার হতে হয়। গাড়িচালকরা ব্যাখায় বলে যে, নারী যাত্রীদের না নেয়ার কারন হল, নারী যাত্রী দাঁড়িয়ে গেলে তাকে দেখে নাকি কিছু পুরুষ যাত্রীরা সেই নারী যাত্রীকে ভীড় করে দাঁড়ায়! এই পুরুষ যাত্রীদের অনেকেই আবার সমাজ স্বীকৃতি শিক্ষিত কিংবা সমাজ কর্তৃক পদবীপ্রাপ্ত বখাটে পুরুষমানুষ! এরা গনপরিবহনে হরহামেশাই নিজেদেরকে যৌন সন্ত্রাস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। অর্থাৎ নারীদের উত্ত্যক্ত করায় মেতে উঠে। যেহেতু বাসে অবস্থানরত সংখ্যা গরিষ্ঠ যাত্রীই পুরুষ হয় এবং খালিচোখে যৌন সন্ত্রাস পুরুষদের চেনা যায় নাই, তাই প্রায়শ, অনেক নারীদেরই রোজ অনেক বাসে প্রবেশাধিকার মেলে না।
২। যেকোন সংগঠন কিংবা কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে টিম ঠিক করবার সময় – “আমাদের কমিটি অথবা টিমে চারজন মেয়ে হয়ে গেছে! পনেরোজনের দলে এর চেয়ে বেশী মেয়ে নেয়ার মানে নেই!” এমন কথা শোনার মত অবজ্ঞা কেবল নারী জাতিদেরই এই একবিংশ অত্যাধুনিক যুগে সহ্য করতে হয়। কোনো ছেলেকে কখনো শুনতে হয় না। হ্যা এখন অনেক “সচেতন” পুরুষ নারীদের জন্য বরাদ্দকৃত কোটার কথা বলবেন। সাথে জানাবেন এই কোটার ফলে ঘটা তাহাদের মতে “অবিচার” এর কথা। পজিটিভ ডিস্ক্রিমিনিজমে নাকি কখনো জেন্ডার সমতা আসবে না। তাদের উত্তরে বলতে চাই, আপনি শুধু নারীদের দেয়া বাড়তি কোটাই দেখলেন? এ কোটা আসবার পিছনে নারীদের কাটানো অবজ্ঞা, বঞ্চনা, ও সুযোহীনতার বাস্তবতা দেখবেন না? সৃষ্টিকর্তা নারী দেহ দিয়ে ধরনীতে প্রেরণ করায় নিজেকে পন্যের মতো ভাবছে অনেকে, এমন গা গোলানো ভাবনাকে দেখবেন না? রোজ নারী পরিচয়ের জন্য যে বাড়তি ঝক্কি কেবল নারীদের পোহাতে হয়, সেখানে কোটাও তো কেবল তাদেরই প্রাপ্য হবে, তাই না? যেদিন সকল বাড়তি অবজ্ঞাবিহীন হয়ে নারীরা একজন ইনডিভিজ্যুয়াল মানুষ হিসেবে নিজ নিজ যোগ্যতা জাহিরের সুযোগ পাবে, সেদিন থেকেই তাদের আর আপনার ভাষ্যমতের “বাড়তি” সুবিধা চাই না।
এ দুইটি ছাড়াও আর হাজারো গল্প আছে নারীদের জীবনে জেন্ডার অসমতা নিয়ে। তবে আমার বিশ্বাস, সহমর্মিতা সম্পন্ন যেকোনো মানুষের পক্ষে এই দুইটি কারণই সামগ্রিক চিরচরিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে চাইবার ইচ্ছা জাগানোর জন্য যথেষ্ট। ৩৬৫ দিনে আজো ৮মার্চ নারীদের জন্য উৎসবের ন্যায়! কেননা এই একটি দিনের উছিলায় হলেও, আমরা সকলে নারীদের নিয়ে একটু হলেও ভাবার জন্য প্রস্তুত হবার পরিবেশ পাই। যেদিন কেবল মেয়েমানুষ হয়ে জন্মানোর জন্যেই নারীদের এমন হাজারো বঞ্চনা পোহাতে হবে না, সেদিন আর বিশ্বজুড়ে নারীদের বঞ্চনার কথা জানানোর জন্য ঘটা করে দেশে নারীদিবস উদযাপনের দরকার পরবে না।
লেখক- রেনেকা আহমেদ অন্তু