ভাবনাজগতে শব্দের দৌরাত্ম

ভাষার সংজ্ঞাতে বলা হয়, যোগাযোগ স্থাপনের জন্য অর্থবোধক শব্দই ভাষা। সরল ভাবে ভাবলে আমরা একে অপরের সাথে যোগাযোগ করার জন্য কিংবা মনের ভাব বোঝাতে ভাষার ব্যবহার করি। এবং ভাষা ব্যবহারে শব্দ নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার! এমনকি ভাষার যথাযথ ব্যবহারের জন্য শব্দের তৎকালীন সময়ের ব্যবহারিক দিকটাও মাথায় রাখা প্রয়োজন। কেননা আমাদের কথা বলার ধরন একে অপরের মধ্যকার সম্পর্কের গভীরতা প্রকাশ করতে পারে।

এখন আমরা যদি একটু সময় নিয়ে ভাবি তবে আরেকটা ব্যাপার বোঝা যায়। আমাদের ভাবনার জগতের ও একটা নিজস্ব ভাষা আছে। যেখানে নিজের সাথে নিজের যোগাযোগ ঘটে। মানে আমাদের সব কিছুই চিনতে তথা যে কোনো কনসেপ্ট বুঝতে আলাদা আলাদা শব্দের এক বা একাধিকবার ব্যবহার ঘটে থাকে। আমরা যা ভাবি তা সবই কোনো না কোনো শব্দ দিয়ে চিনি। যে ভাবনাকে আমরা কোনো নাম দিতে পারি না তথা কোনো কনসেপ্টের সাথে যুক্ত বা রিলেট করতে পারি না সেই ভাবনাকে আমরা আসলে সাবলীলভাবে ভাবতেও পারি না!

যেমন ধরুন, সামাজিক বিজ্ঞানে একটা শব্দ আছে “mundane”। ইমিল ডুর্খেম নামের এক তাত্ত্বিক এই শব্দটাকে তার ধর্মতত্ত্বে ব্যবহার করেছেন। আমাদের কাছে ততক্ষণ এই শব্দটা কোন কাজের জিনিস না, যতক্ষণ আমরা এটাকে আমাদের চিন্তা জগতের কোন কনসেপ্ট এর সাথে জুড়ে দিতে পারছি। আসলে তাত্ত্বিক এই শব্দটা ব্যবহার করেছেন এমন বস্তুদের বুঝাতে যাদের সম্পর্কে আমাদের মাথায় “পবিত্র” কিংবা “অপবিত্র” কোনো ধরনেরই ধারণাই বিরাজ করে না।

উদাহরণে যদি বলি, একজন ইসলাম ধর্মালম্বী হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, শূকরের মাংস আমার কাছে অপবিত্র আর ভেড়ার মাংস আমার কাছে পবিত্র। কিন্তু উটের মতো দেখতে নাম না জানা কোন প্রাণীর মাংসকে আমি একজন মুসলিম হিসেবে পবিত্র ডাকবো না অপবিত্র ডাকবো তা আমি জানি না! এখন সে মাংসকে নিয়ে ভাবতে হলে হয় আমাকে সেটা পবিত্র কিংবা অপবিত্র কোন তালিকায় ফেলতে হবে নয়তো নতুন কোন শব্দের জন্ম দিতে হবে। যেহেতু আমার মাথায় ইতিমধ্যে এমন ধারণাকে ডুর্খেমের সুবাদে “mundane” ডাকার কথা ইনপুট দেয়া আছে তাই সে মাংস আমার কাছে হবে “mundane”. যদি আমি এই শব্দটা না জানতাম তবে সেই প্রানীর গোশত নিয়ে আমার ভাবনা এতো সাবলীল হতো না।

তাই বলা যায়, কেবল অপরের সাথে যোগাযোগের জন্য নয় বরং নিজের সাথে নিজের আলাপের (সেল্ফ টক) সময়ও শব্দ নির্বাচনে সর্তকতা প্রয়োজন। কারণ আমাদের কথা বলার ধরন ও শব্দ নির্বাচন যেমন একজন মানুষের সাথে আরেকজন মানুষের সম্পর্ক ভালো কিংবা খারাপ করতে ভূমিকা রাখে তেমনি আমাদের চিন্তাজগতেও সঠিক শব্দ নির্বাচন আমাদের মানসিক সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

প্রচলিত কথন আছে,
“words can kill you,heal you and can make you feel even”
তাই কোনো প্রেক্ষাপটে নিজের মানসিক সুস্থতার জন্য নিজের ভাবনার জগতে নিজেকে ইতিবাচক শব্দের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করার সুফল আছে। তাই আজ থেকে নেতিবাচক কনসেপ্ট এর সাথে জড়িত শব্দগুলোকে ইতিবাচক মোড়কে আনার চর্চা করুন।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কোনো কিছু  অর্জন না করতে পারলে,  ”আমি কি পাপ করছি যে এটা পেলাম না” ভাবার পরিবর্তে “আমার ত্রুটিটি কোথায়” ভাবুন।
কারণ, যখন আপনি নিজের সাইকোলজিকালওয়ার্ল্ডে নিজের অর্জনের প্রতিবন্ধকতা না পেরুতে পারাকে “পাপ” ডাকবেন তখন স্বভাবতই এটা নেতিবাচকতা বাড়াবে যা আপনাকে অশান্তি দিবে। কিন্তু এটাকে “ত্রুটি” ডাকলে সে ব্যাপারে সফলতা অর্জনের ব্যাপারে মস্তিষ্ক ভাবতে চাইবে,চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিবে। এই ত্রুটি দূর করার জন্য বিকল্প উপায় খোঁজার জন্য কাজ করতে থাকবে।

“আমি ব্যর্থ” এটা না ভেবে,
-যারা সফল তাদের থেকে আপনি কোন কোন বিষয়ে আলাদা এবং কেনই বা আলাদা তা ভাবুন।
-কারাই বা তাদের কখন সফল ডাকছে তা লক্ষ্য করুন।

এতে করে আপনি যেমন নিজের ভাবনা জগতের বহুমুখীতা তথা versatility বাড়াতে পারবেন তেমনি নিজের প্রত্যেক কৃতকর্মের থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতাকেও প্রয়োজনমাফিক শিক্ষারূপে কাজ করিয়ে নিতে পারবেন। যোগাযোগ স্থাপনে দক্ষ হয়ে যাবেন!

লেখক- অন্তু, রেনেকা আহমেদ,শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। “ভাবনাজগতে শব্দের দৌরাত্ম”, দৈনিক বর্তমান সময়।

২৫ জুন ২০২০, বৃহস্পতিবার

http://bortamansomoy.com/home/news_description/18741/%E0%A6%AD%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A6%9C%E0%A6%97%E0%A6%A4-%E0%A6%B6%E0%A6%AC%E0%A6%A6%E0%A6%B0-%E0%A6%A6%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A6%AE?fbclid=IwAR24h0OQhnzJfLjGzdQ83d_tsBJwsJM4S1fo0KVc72r_6HkTMu2wAsP6bJ8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *