একটা লেখা কিছুদিন ধরে ফেসবুকের টাইম লাইনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। লেখাটা একজন নারী (জাকিয়া সুলতানা, গাইনোকোলজিস্ট) বিসিএস ক্যাডারের। সে লেখাটা উনি নিজে লিখেছেন নাকি অন্য কোথাও থেকে কপি কিরেছেন তা জানতে পারিনি। তিনি কাউকে ক্রেডিট দেননি। তাহলে ধরেই নেওয়া যায় লেখাটা তিনিই লিখেছেন। সে লেখাটা কোনো মেয়ে লিখুক বা ছেলে লিখুক সে বিতর্কে পরে আসা যাবে। লেখার এক এক টা শব্দ, একেকটা বাক্য বিতর্কের সৃষ্টি করে। এ যুগেও মানুষ এভাবে ভাবতে পারে?
কেনো এত ভাবছি সেটার জন্য হুবহু লেখাটা এখানে তুলে ধরলাম-
❝ভয়ংকর এক নারী প্রজন্মের অপেক্ষায় আমরা!! ৭৫% উচ্চ শিক্ষিত মেয়ে ২৭ থেকে ৩০ বয়সেও বিয়েহীন। ক্যারিয়ার গড়তে গিয়ে এরা এমন এক সংকট তৈরী করেছে যে। আগামী ৫ বছরে লাখ লাখ মেয়ে বিয়েহীন থাকবে৷ তাদের যৌবনের চাহিদা, আবেগ,ভালোবাসা হারানোর ফলে। স্বামীর মন জয় করার পরিবর্তে স্বামীর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েই সংসারে দরকষাকষি করবে৷ আর স্বামীও তাদের মাঝে আনুগত্য, কোমলত্ব,নারীত্ব না পেয়ে অসহ্য হয়ে উঠবে। তখন সংসার টিকানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। কারণ তার স্ত্রী ৩০ টা বছর পুরুষের ফিতরাতে টেক্কা দিয়ে সে নিজেই পুরুষে বিবর্তিত হয়ে গেছে। তার আস্ত দেহটাই নারীর বৈশিষ্ট্য হলেও। সে মানসিকভাবে পুরুষ। স্বামী তাকে দৈহিক ভাবে নারী পেলেও সে মেন্টাল ভাবে পুরুষ।এমন একটা দিন আসতে যাচ্ছে। মেয়েরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে যৌবন থেকে যেমন বঞ্চিত হবে। বঞ্চিত হবে সংসার থেকেও। বঞ্চিত হবে আখিরাতের মুক্তি থেকেও। ❞।
আমি যার টাইমলাইনে দেখেছি তিনি একজন শিক্ষক। একজন শিক্ষকের চিন্তাধারা যদি হয় এরকম তবে সে জাতির ভবিষ্যৎ কি হবে? নিশ্চয় ওই শিক্ষকের কাছে শুধু পুরুষ শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে যাবে না। আর যদি শুধু পুরুষ শিক্ষার্থীও পড়তে যায় শিক্ষক তো তার চিন্তাধারাটাই তার পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। ঘটনা টা বাত্তির নিচে অন্ধকারের মত হয়ে গেলো না?? যিনি লিখেছেন তিনি নিজে বিসিএস ক্যাডার, এমবিবিএস ডাক্তার। যিনি বা যারা শেয়ার দিচ্ছেন অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিতে নয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে কর্মজীবনে আছেন। তাহলে আমরা প্রতিবছর নারী দিবস থেকে কি শিক্ষা গ্রহণ করি তা একটা বিরাট প্রশ্নের মতই।
এবার আরও একটা বাস্তব ঘটনায় আসি। এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, “নারীর সমঅধিকার, নারীর সমসুযোগ, এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ।” নারী দিবসের একটা প্রোগ্রামে একজন আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, আচ্ছা এই যে বিনিয়োগ, এই বিনিয়োগ বলতে কি বুঝিয়েছে? আমি আমার যতটুকু জানার পরিধি সেখান থেকে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, নারী শিক্ষা, স্বাস্থ্য এসব বিষয় নিশ্চিত করার জন্য বিনিয়োগের কথা বলা হয়েছে। নারী যেনো শুধু নারী বলেই পিছিয়ে না পড়ে। তাকেও পুরুষের পাশাপাশি সমান সুযোগ দেওয়া হোক। তখন তিনি মুচকি হেসে বললেন, একটা গল্প শোনাই। আমার এক সহকর্মী দেশের বাইরে থাকতেন। তিনি তার সমস্ত উপার্জন তার স্ত্রীকে পাঠাতেন। এটাও তো বিনিয়োগ। তারপর তিনি দেশে ফিরে দেখলেন তার স্ত্রী অন্য কারও সাথে সংসার বেধেছে। এরকম বিনিয়োগ হলে তো…! উনি কি বোঝাতে চাইলেন আমি বুঝলাম। তারপরেও তাকে বললাম, ভাল বা খারাপ নারী পুরুষ উভয়ের মধ্যেই আছে।। পুরুষ কি অন্যায় করে না? তাই বলে কি সব পুরুষ জাতিই এক রকম? শুধু কি নারীই পুরুষের টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়? তখন তিনি শেষ বয়সের ভরসার কথা বললেন। একজন নারী তার বাবা মার বৃদ্ধ বয়সে ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করবে না। একজন পুরুষ করবে। তাই শুধু শুধু নারীর উপর বিনিয়োগ করে কি হবে?আমি তাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলাম-আচ্ছা, বৃদ্ধাশ্রমে বা রাস্তায় যেসব বৃদ্ধ বাবা-মা কে পাওয়া যায় তারা সবাই কি নারীর বাবা-মা? কোনো পুরুষের বাবা-মা নয়? বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মায়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করবে কি করবে না এটা একজন। মানুষের নারী পুরুষ হওয়ার উপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে সে কেমন সন্তান? নারীও তার বাবা-মায়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে পারে। যার বহু নজির আছে।
এই তো গেলো গত কিছুদিনের দুটো ঘটনা। এরকম অহরহ ঘটনা আমাদের আশেপাশে আছে। এরকম অসংখ্য চিন্তাধারার মানুষ আমাদের মাঝে আছেন। যার জন্যই আজ নারীদের নিয়ে এত আলোচনা হলেও কাঙ্খিত সাফল্য আমাদের ধরা ছোয়ার বাইরে। নারী দিবসের অনুষ্ঠান আয়োজন করা ব্যক্তিটাও নারীর সম অধিকার নিয়ে চিন্তা করে কি না কে জানে! সে হয়ত শুধুমাত্র তার চাকরির প্রয়োজনে কাজটা করছে কিন্তু তার পরিবারের ক্ষেত্রে সে অন্যভাবে ভাবছে। সোজাভাবে বললে যতদিন না পর্যন্ত ব্যক্তির ভেতর বাহির এক চিন্তা করবে ততদিন পর্যন্ত নারীর মুক্তি সম্ভব নয়। অন্তরে এবং কাজে কর্মে একই ধারণার বহিঃপ্রকাশ আনবে নারীর উন্নয়ন, সম্ভব হবে নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথে বিনিয়োগ। গড়ে উঠবে সমৃদ্ধ নারী সমাজ।
উম্মে কুলছুম
স্পেশালিষ্ট, সোশ্যাল ইনক্লুশন স্কিলস ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম, ব্র্যাক।।