উই ম্যাটারস

‘দি ব্রেভ গার্লস’ গত ২৫ নভেম্বর থেকে জেন্ডার ভিত্তিক সহিংসতা রোধের উদ্দেশ্যে “সিক্সটিন ডেইস অ্যাক্টিভিজম: লেটস স্পিক আপ” ক্যাম্পিং করে আসছে। ক্যাম্পেইনের একটি কর্মসূচি স্টোরি টেলিং সেশন। এছাড়াও ক্যাম্পিনং এর কর্মসূচিতে থাকছে; বিষয়ভিত্তিক আলোচনা সিরিজ, প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা, বিশেষ আলোচনা সিরিজ। স্টোরি টেলিং সেশনের প্রথম পর্বের বিষয়বস্তু ছিল উই ম্যাটারস। রবিবার (৬ ডিসেম্বর) রাত নয়টায় জুম ভিডিও কনফারেন্স প্ল্যাটফর্ম এবং ফেইসবুক লাইভ স্ট্রিমে পর্বটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন; মশিউর রহমান,ফারজানা আক্তার, নুসরাত জাহান বিন্দু, নিশাত আফরোজ।

প্রথমে জীবনের গল্প শেয়ার করেন ছোটবেলা থেকেই বাবাহীনভাবে বেড়ে ওঠা ফারজানা আক্তার। তিনি তার প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করেন গল্প বলা। শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ফারজানা ক্লাস সেভেনে ভর্তি হতে পারে না শুধু মাত্র তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য। এসএসসির পরে অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে এবং চলাচলে সুবিধার জন্য টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে চলে যান খালার বাসায়। এইচএসসির পর আবার নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন। টিউশনি এবং কিন্ডার গার্ডেনে চাকুরির মাধ্যমে নিজের বিবিএর পড়াশোনার খরচ চালান। এভাবেই এগিয়ে চলে ফারজানার জীবনের গল্প। এখন তিনি বার্জার পেইন্টসে একাউন্টস অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। করোনাকালীন অসুবিধার মুখোমুখি তিনিও হয়েছেন বলে জানান। ডিজিটাল বিশ্বে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার নারীরা অনেক পিছিয়ে আছে বলে তিনি মনে করেন।

মশিউর রহমান সমাজের তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধিত্ব করেন। ২২ বছরের জীবনের গল্পে মশিউর বলেন পরিবারের মানুষ তাকে পুরুষ সন্তান হিসেবেই বেড়ে তোলেন। কেউ বুঝতে পারেন নাই শুরুতে। দিন ভালই কাটছিল তার। ছোটবেলায় তিনি সাজুগুজু পছন্দ করতেন, মেয়েদের সাথে খেলতে পছন্দ করতেন। তিনি সবচেয়ে বেশি সমস্যার শুরু হয় যখন স্কুলে ভর্তি হন। সবাই তাকে অন্যজগতের মানুষের মত ট্রিট করতেন। আচার-আচরণ, কথা-বার্তার জন্য সবাই তাকে এড়িয়ে চলত। অনেক বুলিংয়ের শিকারও হতে হয় তাকে। এলাকার মানুষজনদের কাছেও তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। সেক্সুয়াল হ্যারেজম্যান্টের শিকার হতে হয়েছে বলেও জানান মশিউর। স্কুলে শিক্ষকরাও তাকে মেনে নিতে পারতেন না। এ জন্য পরিবারেও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতেন। তিনি সব সময় চাইতেন আল্লাহ যেভাবে তাকে পাঠিয়েছেন সেভাবেই থাকতে চান। সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণেই পরিবার তাদের সন্তানদের হিজড়া সংস্কৃতিতে পাঠাতে বাধ্য হয় বলে জানান তিনি। নিজের জীবনের এত প্রতিবন্ধকতা তাকে কঠোর হতে বাধ্য করেছে বলে মনে করেন তিনি। বাইরের সমস্যা থেকে বাচানোর জন্য তার বাবা তার জামা-কাপড় কেটে ফেলতেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি। ছোটখাটো কাজ করে হাত খরচ চালাতেন তিনি। পরিবার থেকেও অনেক কথা শুনতে হয় তাকে। সমাজ সম্পর্কে জ্ঞান হওয়ার পর নিজেকে শোধরানোর চেষ্টা করেন। একটা সময় পরিবারের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের কারণে ঢাকায় চলে আসেন । সেখানে এসে হিজড়া সংস্কৃতিতে আসেন। তারপর নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েন। তিন চার বছর পর তিনি বাসায় ফিরে আসেন তবুও আগের মতই নির্যাতনের শিকার হন। তখন তিনি সুইসাইডের চেষ্টা করেন। তখন তার মা তার কাছে আসেন নাই। এরপর তার ক্যান্সারের ঝুঁকি দেখা দেয়। তাকে দিনে ৪৮ টা ইঞ্জেকশন দিতে হয়। এই ঘটনার পর তার মেমোরি লস হয়, অনেক সময় তিনি অনেক কিছুই মনে করতে পারেন না। ভলান্টারি বিভিন্ন কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন আগে থেকেই। খুলনায় একটা চাকরি করলেও সেখানে ৭ মাস চাকরির পর আবার ঢাকায় চলে যান হিজড়া সংস্কৃতিতে। এরপর আবার চাকরিতে ফেরেন অনেক সংগ্রাম করে।

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নিশাত আফরোজের পরিবার অনেক চিকিৎসা করিয়েছেন যেন সুস্থ হয়ে ওঠেন। নিজের চার বোনের ভালবাসায় তিনি পড়াশোনায় এগিয়ে যান। স্কুলে তেমন সমস্যার সম্মুখীন না হলেও কখনো স্পোর্টস এ অংশ নিতে পারতেন না। পরীক্ষার সময় আলো কমে গেলে শিক্ষকেরা সাহায্য করতেন। বাবা মারা যাওয়ার পর মা তার ঢাল হয়ে ওঠেন। দৃষ্টিতে সমস্যা থাকার কারণে নিজের পছন্দের কাজগুলো তিনি করতে পারতেন না। বৃষ্টি সবসময় তার জীবনের ভিলেন হিসেবে কাজ করেছে। আলো স্বল্পতার জন্য হয়ত চাকরির পরীক্ষাগুলো ভাল করে দিতে পারতেন না। নিজেকে কখনো প্রতিবন্ধী হিসেবে দেখেননি তিনি। মাস্টার্স শেষ করার পর দীর্ঘ ৪ বছর পর প্রতিবন্ধীদের চাকরির মেলাতে সিভি জমা দিলেও সেখানে তার কিছু হয় না। কিন্তু সেই মেলার একজনের থ্রুতে তিনি বিসক্যানে তে চাকরি করে যাচ্ছেন। নিজের ডিপ্রেশন থেকে তিনি ফিরে এসেছেন এভাবেই। শুধুমাত্র ফিজিক্যালি ডিজেবল ব্যক্তিদের নয় যারা দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্যও আইটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে ভাল হয় বলে মতামত প্রকাশ করেন তিনি।

নুসরাত জাহান বিন্দু তার জীবনের গল্পতে বলেন তিনি ছোটবেলা থেকেই স্কুল কলেজ বা পরিবার থেকে সমস্যার সম্মুখীন হননি। তার বাবা তাকে আলাদা করে বেঞ্চ বানিয়ে দিতেন যেন তার বসতে সমস্যা না হয়। সমাজের এত সমস্যার মাঝে একটা পজিটিভ বাংলাদেশের গল্প বলেন তিনি। পরিবারের সবাই তাকে খুব সাহায্য করেছে এই সমাজে এগিয়ে যেতে। তিনি ফিজিক্যাল ডিজেবিলিটিকে পেছনে ফেলে তার দুই পা দিয়েই সব কাজ করে থাকেন।

“ভিন্নতাকে” বিউটি হিসেবে উল্লেখ করে ভিন্নতাকে মেনে নিয়ে এ সমাজ এগিয়ে যাবে এমন প্রত্যাশা করেত উপস্থাপক রেনেকা আহমেদ অন্তু সেশনটির ইতি টানেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *